তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ না পাওয়ায় শেয়ারবাজারে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাবে বাজারে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকটও। ফলে টানা দরপতন দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, চীনের দুই প্রতিষ্ঠান শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়ামকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে পাওয়া দেশের শেয়ারবাজারের বিরাট সুখবর। এর আগে ব্যাংকের তারল্য বাড়াতে সরকার থেকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। অথচ এমন দুটি সুসংবাদের কোনো ইতিবাচক প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনের পর দিন দরপতন হচ্ছে। এ দরপতনের মূল কারণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিনিয়োগকারীরা প্রত্যাশিত লভ্যাংশ পায়নি। ব্যাংক কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার হার কমে গেছে। এমনকি কিছু কোম্পানি নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে আশঙ্কাজনক হারে বোনাস শেয়ার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এরই নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে বাজারে। ৮ মে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। দরপতনের এ ধারা টানা পাঁচ কার্যদিবস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তাছাড়া মূল্যসূচকের পাশাপাশি এদিন প্রধান বাজার ডিএসইতে লেনদেন হওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমেছে। সেই সঙ্গে কমেছে লেনদেনের পরিমাণও। বাজারটিতে ৮৩ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২২৩টির। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৩২টির দাম।
৮ মে টাকার অঙ্কে ডিএসইতে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকোর শেয়ার। কোম্পানিটির মোট ২৮ কোটি ১২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৯ কোটি ১৬ লাখ টাকার। ১৮ কোটি ৩১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন। লেনদেনে এরপর রয়েছেÑ গ্রামীণফোন, নাভানা সিএনজি, সিটি ব্যাংক, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং বিবিএস কেবলস। এদিকে, বড় ও ভালো কোম্পানি শেয়ার বাজারে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কাজ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে প্রয়োজনে কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনা এবং কর হার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সিটি গ্রুপ, আকিজ গ্রুপের মতো বড় কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার বিষয়ে শেয়ার বিশেষজ্ঞরা বলেন, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তালিকাভুক্তির বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আসার সুবিধাগুলো বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কর রেয়াত সুবিধা, ঋণের মতো সুদ দেয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, পরিচিতি বাড়ে ইত্যাদি তুলে ধরতে হবে। যাতে কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে আসতে আগ্রহী হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল কোম্পানি শেয়ার বাজারে আসার ক্ষেত্রে প্রায় সবসময়ই ইস্যু ম্যানেজারদের দায়ী করা হয়। শেয়ার বাজারে আসার সময় কোনো কোম্পানিই দুর্বল থাকে না। তবে তালিকাভুক্তির সময়ে কিছু উদ্যোক্তা পরিচালকদের অসৎ উদ্দেশের কারণে কিছু কোম্পানি দুর্বল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো উদ্যোক্তা পরিচালক আইপিও ফান্ডের অপব্যবহার করে, টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলে তার দায়ভার ইস্যু ম্যানেজারের না। কারণ কোনো উদ্যোক্তা পরিচালকের মনের খবর বোঝা সম্ভব নয়।
২০১৭ সালে ব্যাংকের সুদহার একক সংখ্যার ঘরে ছিল। যদি কম সুদে ব্যাংকের টাকা ঋণ হিসেবে পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে অনেক উদ্যোক্তাই পুঁজিবাজারের চেয়ে ব্যাংকের দিকে ঝুঁকবেন। সেটিও ঘটেছে। কারণ একটি কোম্পানিকে ‘এ’ ক্যাটাগরি ধরে রাখতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে হয়। যা ব্যাংকের সুদহারের চেয়ে বেশি। সেই কারণে কম আইপিও জমা পড়েছিল। তবে ২০১৭ সালে যত ফাইল জমা ছিল, তাতেও আইপিওর সংখ্যা ৭টির বেশি হওয়া সম্ভব ছিল। বড় কোম্পানিগুলো কি শেয়ারবাজার আসার সুবিধা সম্পর্কে জানে না বলেই আসছে নাÑ এ বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার শামসুল আলম বলেন, প্রকৃতপক্ষে অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তারা ব্যবসাই বুঝে, কমপ্লায়েন্স বুঝে না। দেশে অনেক কোম্পানি আছে, যেখানে পেশাজীবী প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) নেই, একাউন্টস ঠিক নেই ইত্যাদি সমস্যা আছে। কিন্তু শেয়ারবাজারে এলে অনেক রুলস-রেগুলেশন্স, কমপ্লায়েন্স মানতে হয়। যা অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তা মানতে চায় না। যে কারণে তারা শেয়ারবাজারে আসতে আগ্রহী নয়।
এজিএম পার্টির দ্বারা নাজেহালের ভয়েও অনেক কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে চায় না এমন অভিযোগের বিষয়ে স্বদেশ খবর-এর কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এজিএম পার্টির ভয়ে উদ্যোক্তারা তাদের কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনতে চায় না, এটা ঠিক না। এজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের কথা বলার অধিকার আছে। তারা কথা বলবে। কিন্তু কেউ অনিয়ম করলে, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি দেখতে পারে। যদি কোনো উদ্যোক্তা এজিএমে অংশগ্রহণকারীদের বাড়তি ঝামেলা মনে করে তবে নিকটস্থ থানার পুলিশের সহায়তা নিতে পারে।
শেয়ারবাজারে নতুন ইস্যু আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধার বিষয়ে এই ব্যাংকার মনে করেন সময়ক্ষেপণ সবচেয়ে বড় বাধা। একটি ইস্যু আনতে দেড় থেকে ২ বছর লেগে যায়। এক্ষেত্রে একটি কোম্পানির মোটিভ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ২ বছর পরে কোম্পানির ফান্ডের দরকার নাও লাগতে পারে। তাই উন্নত বিশ্বের মতো ফাইল জমা দেয়ার ৩ মাসের মধ্যে আইপিও অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
একইসঙ্গে ইস্যু আনতে সময়ক্ষেপণের কারণ হিসেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে ইস্যু ম্যানেজারদের দায়ী করা হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আপনাদের ভুল ধরিয়ে দেয়ার পরে সংশোধন করবেন এমন অপেক্ষায় থাকেন বলে অভিযোগ করে। এই বিষয়ে ওই ব্যাংকার স্বদেশ খবরকে বলেন, ইস্যু ম্যানেজারদের কিছু সমস্যা আছে। তারা সব কমপ্লায়েন্স পরিপালন না করেও ফাইল জমা দেয়। তবে ইস্যু ম্যানেজাররা এখন সক্রিয়। ভালো কোম্পানির ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স পরিপালন কিছুটা শিথিল করা দরকার। এক্ষেত্রে একটি কোম্পানির টেক্স ফাইল দেখলেই বোঝা যায়, কোম্পানিটি কতটা ভালো।
0 Comments