নিজস্ব প্রতিবেদক : শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বাজেটের আকার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য সম্ভাব্য বাজেটের আকার হতে পারে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। জনগণের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য এই বিশাল আকারের বাজেট তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
টাকার অঙ্কে এটি হবে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় বাজেট। তবে এ বাজেট প্রণয়নকাল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর হওয়ায় ভোট আকর্ষণে এবার কর ও ভ্যাটে বড় ধরনের ছাড় দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে রাজস্ব আদায়ে করের আওতা বাড়ানো হবে। এ লক্ষ্যে বেশিসংখ্যক মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে কর এবং ভ্যাটের আওতায় এনে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দিতে ভ্যাটের হার অপরিবর্তিত থাকছে। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আগামী বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ থাকবে বলে জানা গেছে।
জনকল্যাণমুখী গ্রহণযোগ্য বাজেট প্রণয়নে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও বরাবরের মতো ৬ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এগুলো হচ্ছেÑ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, রেলপথ ও বন্দরসহ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসৃজন প্রকল্প, সরকারি সেবা প্রদানে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন, জলবায়ু মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জন এবং বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ অধিকতর ব্যবহার ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রপ্তানি বাজার অনুসন্ধান।
এই ছয় খাতের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হলে রূপকল্প-২১ এবং ভিশন-২০৪১ সময়কালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া আগামী বাজেটে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে তা হচ্ছে ৪০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জেন্ডার বাজেট রিপোর্ট প্রণয়ন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ ও এ সংক্রান্ত নতুন ধারণাপত্র প্রণয়ন এবং শিশু বাজেট ও ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা হালনাগাদ করা।
পাশাপাশি পদ্মা সেতুসহ ১০ মেগা প্রকল্পের জন্য আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ১০ মেগা প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমডিজি অর্জনের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এ কারণে বাজেটে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে আগামী বাজেট নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। ওই সময় তিনি বলেন, আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের আকার সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা করা হতে পারে। করদাতার সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীই বাজেটের আকার বাড়ানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, ৪০ বছর বয়সী করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া দেশের জন্য ভালো লক্ষণ। এছাড়া তরুণরা কর দিতে উৎসাহিত হচ্ছে। কর আদায়কারীরা আরও বেশি করবান্ধব হলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হবে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট আইন সংশোধনের বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেয়া হবে। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন-২০১২ দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশ রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাই আগামী বাজেটেও ভ্যাট হার চলতি বাজেটের মতো অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। তবে ভ্যাট আইন সংশোধনের বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেয়া হবে বাজেটে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে আইনটি সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইএমএফের পরামর্শ না নিয়ে বরং বাস্তবতার নিরিখে এদেশের ব্যবসায়ী সমাজের কথা বিবেচনায় নিয়ে আইনটি কার্যকর করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্যাটের বিষয়টির এখনও চূড়ান্ত কোনো সুরাহা হয়নি। ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আইনটি দুই বছরের জন্য স্থগিত করেছেন মাত্র। এ কারণে আগামী বাজেটের পর কিভাবে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে ব্যবসায়ী সমাজের উদ্বেগ রয়েছেই গেছে। আইনটি কার্যকর করতে হলে এটি আরও যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী করতে হবে। এজন্য আইনটিতে বড় ধরনের সংশোধনী প্রয়োজন। আইনটি কিভাবে কী প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে সেটি নিয়ে এখনই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে এনবিআরের বসা উচিত। একই সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন তাদেরও মতামত নেয়া প্রয়োজন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী অতি দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। গত ২০০৫ সালে দেশে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ, সেখানে ২০১৩ সালে এ সংখ্যা কমে এসেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশে। একই সময়ে অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। বর্তমান এ হার ২২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আগামী ২০২১ সালের পর এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ১৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার সরকারি উদ্যোগ রয়েছে। মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিকল্পনা করে দরিদ্রবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের কারণে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমেছে। একই সঙ্গে দূর হয়েছে বৈষম্যও।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের একজন ইকোনমিস্ট স্বদেশ খবরকে বলেন, গত ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দরিদ্রতা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে, যা ২০১৫ সালে করার কথা ছিল। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্রতার হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে প্রবৃদ্ধির গড় হার ৮ শতাংশের উপরে থাকতে হবে। ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দরিদ্রতা কমে শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এই ইকোনমিস্ট আরো বলেন, বাংলাদেশের দরিদ্রতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হলে অগ্রাধিকার নির্ণয়, অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। এছাড়া আগামী বাজেটে কর্মসংস্থানে বিশেষ পদক্ষেপ থাকবে। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর কৌশল নেয়া হচ্ছে।
অবশ্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটের আকার বাড়ানোর পাশাপাশি বাস্তবায়নও দরকার। তাই প্রণীত বিশাল এ বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের দিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। আর তাহলেই কেবল বাজেটের প্রত্যাশিত টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
0 Comments