সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পুঁজিবাজার

 নিজস্ব প্রতিবেদক : গেল সেপ্টেম্বর মাসে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মোট ৯৪৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা লেনদেন করেছে; যা গত মাসের চেয়ে ১১৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা বা ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। মাসজুড়েই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ক্রয়ের আগ্রহ ছিল বেশি। গেল মাসে বৈদেশিক লেনদেনে ক্রয়কৃত সিকিউরিটিজের পরিমাণ ছিল ৫৬০ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং বিক্রয়কৃত সিকিউরিটিজের পরিমাণ ছিল ৩৮৬ কোটি ৫ লাখ টাকা।


বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছরে নানা ধরনের সংস্কার করা হয়েছে। আইনি অবকাঠামো উন্নত করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচ্যুয়ালাইজড করা হয়েছে। তাছাড়া বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নীতিমালা করা হয়েছে। তাই এখন আমাদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে বিশ্ব বাজারে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনও অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি লাভজনক। তাই আমাদের পুঁজিবাজার নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে দিন দিন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন ও নিট বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে।

ডিএসইর তথ্যে দেখা গেছে, গেল আগস্টে বৈদেশিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৮৩২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্রয়কৃত সিকিউরিটিজের পরিমাণ ছিল ৪৩২ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং বিক্রয়কৃত সিকিউরিটিজের পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে শেয়ারে নিট বিনিয়োগ আগস্ট মাসের চেয়ে ১৪২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বা ৪৫০ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়ার প্রত্যাশা করছেন। ৩ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে আইনগত নানা দুর্বলতা ছিল। এসব দুর্বলতা দূর করা হয়েছে। নানা আইনি সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের পুঁজিবাজার এখন অনেক উন্নত। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে। আগামী কয়েক বছরে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে।

মার্চেন্ট ব্যাংকাররা বলছেন, পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ভালো কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহও বাড়াতে হবে। কারণ বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার কম হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অল্প কিছু কোম্পানিতেই বেশিরভাগ বিনিয়োগ করেন। সম্প্রতি ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও বর্তমানে এ ব্যাপারে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বাজারের স্বার্থে বহুজাতিক কোম্পানিসহ ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তাছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন করেন। অনেক সময়ই আমাদের কোম্পানিগুলোর আর্থিক তথ্যে অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির তথ্যের সত্যতা নিশ্চিতের দাবি জানান। মার্চেন্ট ব্যাংকাররা বলছেন, সম্প্রতি ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল করা হয়েছে। দ্রুত তাদের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এ কাউন্সিল কিছু দৃষ্টান্তমূলক কাজ করতে শুরু করলে কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনেও স্বচ্ছতা ও সত্যতা আসবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বাড়বে।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতির কারণে গত দুই মাস ধরেই ঊর্ধ্বমুখী বাংলাদেশের পুঁজিবাজার; যা আরো চাঙা হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করায় বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। আগামী দিনগুলোতেও বাজারের এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন তারা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছেন, পুঁজিবাজার এখন সঠিক পথেই রয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, বাজার স্থিতিশীল করতে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তারই ইতিবাচক ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কারণেই পুঁজিবাজারে চাঙাভাব ফিরছে বলে অর্থমন্ত্রীর মতোই মনে করেন ডিএসইর সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী। তিনি স্বদেশ খবরকে বলেন, ‘কয়েক মাস আগেও দেশে জঙ্গি-জঙ্গিভাব যেটা ছিল, সেটা কেটে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার কমেছে। সবাই এখন পজিটিভ মুডে আছে। এসব কিছুর কারণেই পুঁজিবাজার ক্রমেই চাঙা হচ্ছে।

বেসরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এইমস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াওয়ার সাঈদ স্বদেশ খবরকে বলেন, এখন যারা বিনিয়োগ করছে তারা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করছে। অন্তত এক বছরের জন্য বিনিয়োগ করছে। এটা বাজারের জন্য ভালো। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ড ঘোষণার সময় হচ্ছে। এসব কারণেও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার কয়েক মাস ধরেই বেশ চাঙা। দ্রুতই সূচক বেড়েছে ১ হাজার পয়েন্টের মতো। এ সময়ে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারদর যেমন বাড়ছে, তেমনই বেড়েছে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার। চাঙা বাজারে বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ছেন। যার কারণে টানা বাড়ছে বাজার। পাশাপাশি সেক্টরভিত্তিক বাজার সংশোধন হচ্ছে। তবে বর্তমান বাজারে দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বিনিয়োগকারীদের। তাই পূর্বেকার কথা চিন্তা করে প্রোপার ওয়েতে বিনিয়োগ করতে হবে।

তারা আরও বলছেন, বাজার চাঙা, লেনদেন ভালো। বাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে। আসছে বিদেশি বিনিয়োগ। সবকিছুই ভালো খবর। কিন্তু বাজারে লাভ হলে অনেকেই টাকা তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের বাজারে ধরে রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভূমিকা নিতে হবে। দুর্বল কোম্পানির দর অস্বাভাবিক বাড়লে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে বিএসইসিকে। কারণ দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এগুলো খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। গুজবে কান না দিয়ে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে। দেরিতে হলেও ভালো মুনাফা আসবে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ