চাল ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত

 অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : বর্তমানে চালের দাম বেশ আলোচিত বিষয়। হঠাৎ করেই চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। অনেকটা কষ্টও সহ্য করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করায় চালের দাম এখন সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করেছে। সম্প্রতি সরকার চাল ব্যবসায়ীদেরকে লাইসেন্স ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ যারা চালের ব্যবসা করবেন, তাদেরকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং প্রতি ১৫ দিন পর পর চালের মজুতের হিসাব সরকারের কাছে দিতে হবে। এই লাইসেন্স ছাড়া যারা চাল ও গমের ব্যবসা করছেন তাদেরকে আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নেয়ার সময়ও বেঁধে দিয়েছে সরকার। এই সময়ের মধ্যে যেসব ব্যবসায়ী লাইসেন্স নেবেন না, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের (আরসি ফুড) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমি মার্কেটিংয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি, সাধারণ ট্রেড লাইসেন্সের বাইরে চাল ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত কোনো লাইসেন্স ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।


বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত চালের আড়ত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এই মুক্তবাণিজ্যের যুগে লাইসেন্স ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে সুফল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। চালের বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং মিল মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন অমান্য করে চাল মজুত করার অভিযোগ রয়েছে। তবে চাল মজুত করার এ ধরনের প্রবণতা অনেক আগে থেকেই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু চাল মজুত রাখার এ প্রবণতাকে কেবল আইন করে অর্থাৎ বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে একটি কাঠামোর অভ্যন্তরে আনলে মজুতজনিত কারণে চালের দাম বৃদ্ধিসংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। বাংলাদেশে চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। কাজেই এক্ষেত্রে চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখার একমাত্র উপায় হচ্ছে চাল সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের সরকারি খাদ্যগুদামে যদি ১০ লাখ টনের মতো খাদ্য মজুত থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা চাল মজুতকরণ থেকে বেরিয়ে আসবেন। অপরদিকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, যেমন অতিদরিদ্রদের চাল দেয়া, ওএমআর-এর মাধ্যমে চাল বিক্রি অব্যাহত রাখতেও কোনো অসুবিধা হবে না। এগুলোর প্রভাব বাজারে পড়বে।

চালের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারি গুদামে চালের স্বল্পতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পুরোদমে চালু না থাকা। আশা করব, বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার লাইসেন্স ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। কারণ লাইসেন্স ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে অনেকেই রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার সুযোগ খুঁজবে। এতে দুর্নীতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে এ ব্যবস্থা অপব্যবহার করার সুযোগ আছে। বরং ব্যবসায়ীরা আগে যেভাবে ব্যবসা করতেন, ঠিক সেই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকুক। সেই সাথে আমাদের দেশে খাদ্য মজুতকরণ, সংরক্ষণ এবং গুদামসংশ্লিষ্ট যেসব প্রচলিত আইন আছে, সেসব আইন অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম তদারকি করা হোক। অন্যদিকে মজুত বাড়ানোর মাধ্যমেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সেটা সরকার আমদানি এবং অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহের মাধ্যমে করতে পারে। যেভাবেই হোক আমাদেরকে খাদ্য মজুত বাড়াতেই হবে। গত পাঁচ থেকে সাত বছর আমাদের অন্যতম সংকট ছিলÑ কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পেত না। অর্থাৎ ধানের উৎপাদন খরচ হতো ছয়শ’ থেকে সাতশ’ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে হতো চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকায়। ফলে বিগত বছরগুলোতে কৃষক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে।

এবারের বন্যায় হাওর অঞ্চল, রংপুর দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা ছাড়া অন্যত্র ধান চাষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ফলে এবার যারা ধান চাষ করেছিল তারা ন্যায্য দাম পেয়েছে বা পাবে। এখন যারা আমন ধান ঘরে তুলবে (ইতোমধ্যে আগাম আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে) এর প্রভাব বাজারে পড়বে। এতে কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাবে, বিগত দিনের লোকসান পুষিয়ে উঠবে। আগামী বছর তারা আরো বেশি করে ধান চাষ করবে। কারণ আমাদের দেশে ধান চাষের আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে। অনেকে ধান চাষের চেয়ে জমি পতিত রাখতে রাজি ছিল। কারণ ধান চাষে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়, ধান বিক্রি করে তা ফেরত আসতো না।

সমাজের একাংশের ব্যয় বাড়ার অর্থ হচ্ছে অন্যদের আয় বাড়ছে। অর্থাৎ একজনের ব্যয় বাড়া মানে অন্যজনের আয় বাড়া। কৃষকদের আয় বাড়লে জাতীয় অর্থনীতিতে এটি প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেÑ যা পরবর্তী বছরে ফসল উৎপাদনে কৃষকদের অনুপ্রেরণা জোগায়। আশা করব বন্যা-উত্তর পুনর্বাসনের জন্য কৃষকদের সাহায্য-সহযোগিতার অংশ হিসেবে যে প্রণোদনা দেয়া হয়, তা যেন সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অথবা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষকদের হাতে পৌঁছায়। আমাদের দেশে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা বিতরণ ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগী এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যের কারণে প্রকৃত কৃষক, যাদের পাওয়ার কথা ছিল তারা পায় না কিংবা তাদের কাছে পৌঁছে না। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে করে তারা সরাসরি প্রণোদনা পেতে পারে। এতে খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে আশা করা যায়।

মূলত খাদ্যের বিষয়টি কেবল চালের উপর নির্ভরশীল নয়। এখন গম উৎপাদন এবং আমদানিও বেড়েছে। এখন চালের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে মোটা চালের সংকট। 



মানুষের আয় বেড়ে যাওয়ার কারণে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে মোটা চালের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। অপরদিকে সরু বা চিকন চালের ফলন কম হলেও এর চাষ বাড়ছে। মোটা চাল থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে দামের বিবেচনায়। স্থানীয় কৃষক মোটা চাল চাষ করতে চায় না। মোটা চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে দাম যে হারে বাড়ছে সরু চালের দাম সেই হারে বাড়েনি। কাজেই মোটা চালের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য আমদানি করার প্রয়োজন হতেই পারে। ঘাটতি আমাদের সাময়িক। কিছুদিন পর বোরো বা নতুন ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে নতুন সমস্যা দেখা দেবে। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে কিছু পরিমাণ উন্নতমানের সরু চাল রপ্তানি করে অপেক্ষাকৃত কম দামে মোটা চাল আমদানি করা যেতে পারে। এটাকে ক্রস-সাবসিডাইজেশন বলা হয়। অর্থাৎ একজনের কাছে অতিরিক্ত দামে বেচে অন্যজনকে কম দামে দেয়া। এটা করা গেলেও চালের বাজারে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আসবে। আর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর যেসব খাদ্য কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো যতদিন পর্যন্ত চাল পর্যাপ্ত না হয়, ততদিন পর্যন্ত বিতরণের জন্য আলু অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এখন পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টন আলু হিমাগারে পড়ে আছে। আলুর দাম নিম্নমুখী হওয়ায় কৃষক হিমাগার থেকে আলু উত্তোলন করছে না। এতে হিমাগারের মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; কারণ তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। দাম কম হওয়ায় কৃষক আলু তুলছেন না। এতে হিমাvগারের বিলও পরিশোধ হচ্ছে না। আলু নিয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আলুর উৎপাদন প্রত্যেক বছরই বাড়ছে। এতে কৃষক হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে আলুর উৎপাদন কমে যাবে। এদিকে আবার নতুন আলু লাগানো শুরু হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে নতুন আলু বাজারে চলে আসবে। কাজেই সামাজিক নিরাপত্তার খাদ্য কর্মসূচিতে আলু যোগ করা যেতে পারে। অর্থাৎ চালের পরিবর্তে আলু বিতরণ। তাই বলে কোনো অবস্থাতেই যেন, ‘ভাতের পরিবর্তে আলু খান’Ñএমন পরামর্শ যেন সরকার থেকে না দেয়া হয়। সামরিক সরকাররা যা করেন ঠিক সে রকম যেন না হয়। গরিব দুস্থদের আলু দেয়া হবে, সে আলু তারা খাক অথবা বাজারে বিক্রয় করুক সেটা তাদের ব্যাপার। এক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে আর একটি ভুল সিদ্ধান্ত যেন না হয়। অর্থাৎ সরকার থেকে কোনোভাবেই ভাতের পরিবর্তে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেয়া উচিত হবে না। আলু দেয়া হবে সাহায্য হিসেবে।

আমদানি বা অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ যেভাবেই হোক খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে ১০ লক্ষ টন খাদ্য মজুত রাখতে হবে। এটি করতে পারলে চালের বাজার স্থিতিশীল হবে। ১০ লক্ষ টন খাদ্য মজুত থাকলে চালের ব্যবসায়ী, আড়তদার কিংবা পাইকাররা চাল মজুত করবে না। কারণ তাতে তাদের মূল্যহ্রাসজনিত লোকসানের ভয় থাকবে। কিন্তু লাইসেন্স করে ব্যবসায়ী হিসাব দেবেÑ এমন ব্যবস্থা অবাস্তব এবং আকাশকুসুম চিন্তা। তাই এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সরকারকে আমি অনুরোধ করছি। আর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় হিমাগারের সংরক্ষিত আলু দুস্থদের দিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। আবার চালের দাম যখন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে, তখন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে চিকন চালের কিছু অংশ রপ্তানি করা যেতে পারে। এর পরিবর্তে মোটা চাল আমদানি করলে গরিব মানুষ কিছুটা কম দামে তাদের প্রয়োজনীয় চাল পাবে।

লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments