নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স প্রবাহ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদেেপর কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে হুন্ডি প্রতিরোধে কড়াকড়ি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে নেয়া নানা উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির এ বিষয়ে স্বদেশ খবরকে বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সেজন্য বাজেটে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এতে আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়বে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন ফজলে কবির।
১৬ মার্চ ২০১৬ সালে দায়িত্ব নেয়া গভর্নর ফজলে কবির প্রথম থেকেই রেমিট্যান্স আহরণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। তিনি বিশ্বাস করেন, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা উপার্জনের মাধ্যমে যা আয় করেন, তার প্রায় পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এই রেমিট্যান্সের পুরোটা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আসে না। ফলে তিনি হুন্ডি প্রতিরোধে কড়াকড়ি আরোপ এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে বিভিন্ন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংকে নীতির আওতায় আনা অন্যতম। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলবহির্ভূতভাবে মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে প্রবাসী আয়ে। তাই মোবাইলে হুন্ডি বন্ধ এবং ব্যাংকিং চ্যানেল রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করতে নানা উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। প্রবাসী আয়ের এ পরিমাণ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। রেমিট্যান্স আহরণের প্রবাহ ধারাবাহিক থাকায় ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
গত ৫ বছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ হাজার ৪৪১ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা (১ ডলার ৮৮ টাক ধরে)। এটি চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা বেশি। সর্বশেষ ৫ অর্থবছরের মধ্যে প্রথম ২ বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা কমলেও বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির দায়িত্ব নেয়ার পর গত ৩ বছরে তা আবার বাড়ছে।
গত ৫ অর্থবছরে দেশে যে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি রেমিট্যান্স এসেছে তার মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৭০২ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার।
গত ৫ অর্থবছরের মধ্যে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্স নিম্নমুখী হলেও ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে বিদায়ী অর্থবছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ১ হাজার ৭০২ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসীরা ১৫৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স।
পঞ্জিকা বছর হিসাবে, ২০১৮ সালে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৫৫৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। ২০১৭ সালে ১ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলার, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স জিডিপিতে অবদান রেখেছে ১২ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর শীর্ষ ১০টি দেশ হলো যথাক্রমে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ওমান, যুক্তরাজ্য, কাতার, ইতালি ও বাহরাইন।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দুই ঈদকে সামনে রেখে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। গত মে মাসে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৭৫ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা একক মাস হিসেবে এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। ধারণা করা হচ্ছে, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে কোরবানি বাবদ প্রবাসীরা অন্তত ১৮০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন; যদিও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।
এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ শামসুল আলম স্বদেশ খবরকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। গত ৩ বছর ধরে যেভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে তা ধরে রাখতে হবে। সেজন্য বিদেশে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা। বিদেশি মিশনে কর্মরত কূটনীতিকদের এজন্য টার্গেট দিয়ে দিতে হবে। শুধু সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, বাহরাইনের দিকে তাকিয়ে না থেকে যে ২৫৭টি দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন আছে, সবগুলো দেশেই জনশক্তি রপ্তানির চেষ্টা বাড়াতে হবে।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধি প্রসঙ্গে শামসুল আলম বলেন, ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদেেপর কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। বিশেষ করে অবৈধ হুন্ডি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমেই বাড়ছে; যা খুবই ইতিবাচক।
0 মন্তব্যসমূহ